আসুন আমরা কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজি-
১। ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত কয়েক লাখ থেকে কয়েকশ হাজার বছর আগে বসবাসরত মানুষের মত দেখতে Hominid প্রাণীদের পরিচয়।
২। ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত মানুষের মত দেখতে Hominid প্রাণীরা কি আদম আঃ এর বংশধর?
৩। আদম আঃ এর আগে কি পৃথিবীতে অন্যান্য বুদ্ধিমান জাতি বসবাস করত? আদম আঃ থেকে Hominid প্রাণীদের রিপ্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল?
৪। বনী-আদমের সাথে অন্যান্য Hominid দের পার্থক্য কি?
৫। মানব ইতিহাসের মাইলফলক: সভ্যতা, কৃষি, এবং ধাতু ইত্যাদির বিকাশ সাধিত হয়েছে আদম আ এর বংশধরের মাধ্যমে, অন্য স্পেসিসের মাধ্যমে নয়।
৬। তাহলে কি বিবর্তন তত্ত্ব সত্য?
————————————————————————————–
১। ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত কয়েক লাখ থেকে কয়েকশ হাজার বছর আগে বসবাসরত মানুষের মত দেখতে Hominid প্রাণীদের পরিচয়।
জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন তত্ত্বের প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী কোনো একদিন হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি; বরং কোটি কোটি বছর ধরে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরল প্রাণী ক্রমে জটিল প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে বলা হয় বিবর্তন (Evolution)। প্রথম জীবের উদ্ভব ঘটেছিল জলজ পরিবেশে, এককোষী জীব হিসেবে। পরবর্তীতে এই জীবগুলো ধীরে ধীরে বহুকোষী প্রাণীতে রূপ নেয়, যারা স্থলে, জলে ও আকাশে বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এই অভিযোজনের ফলেই নানা ধরনের প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। এখানে সংক্ষেপে মানুষের বিবর্তন কিভাবে হলো সেটি আলোচনা করা হলো-
বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ডাইনোসররা পৃথিবীতে বসবাস করত, সম্ভবত উল্কাপিণ্ডের আঘাতে হঠাৎ করে ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বেঁচে যায়, ডাইনোসর বিলুপ্ত হওয়ার পর এইসব ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্য থেকে প্রাইমেটদের (monkeys, apes ইত্যাদি) উদ্ভব ঘটে। এরা ছিল গাছে বসবাসকারী এবং চটপটে প্রাণী।
প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন বছর আগে, এই প্রাইমেটরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা মহাদেশে — এরা হলো New World Monkeys। অন্যদল আফ্রিকা ও এশিয়ায় — এরা হলো Old World Monkeys। এই পুরনো বিশ্বের বানরদের মধ্য থেকেই এক নতুন শাখা আলাদা হয়ে গঠিত হয় — এপ (Apes)। এই এপরা পরবর্তীতে বিবর্তিত হয় গরিলা, শিম্পাঞ্জি আর মানুষে।
তারপর প্রায় ৭ থেকে ১০ মিলিয়ন বছর আগে, আফ্রিকার কোথাও এক প্রাণীর জন্ম হলো, যারা ছিল না পুরোপুরি মানুষ, আবার না পুরোপুরি শিম্পাঞ্জি। এরা ছিল মানুষের ও শিম্পাঞ্জির Last Common Ancestor (LCA)। তারা গাছে যেমন চলাফেরা করত, তেমনি প্রয়োজনে মাটিতেও নামত।
প্রায় ৭ মিলিয়ন বছর আগে এই পূর্বপুরুষ থেকেই আলাদা হয়ে গেল মানুষের নিজস্ব শাখা, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন হোমিনিন লাইন (Hominin Line)। প্রথমেই আসে Sahelanthropus tchadensis, যাকে মনে করা হয় মানুষের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষদের একজন। এর পরের ধাপে আসে Australopithecus, যারা আংশিকভাবে সোজা হয়ে হাঁটত এবং আফ্রিকার নানা অঞ্চলে বসবাস করত। Homo habilis, প্রায় ২.৪ মিলিয়ন বছর আগে, যারা প্রথম হাতিয়ার ব্যবহার শিখেছিল। এরপর দেখা দেয় Homo erectus, প্রায় ১.৯ মিলিয়ন বছর আগে, যারা সম্পূর্ণ সোজা হয়ে হাঁটত এবং প্রথমবারের মতো আফ্রিকার বাইরে এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
তারপর ইতিহাসে দেখা দেয় এক বিশেষ প্রজাতি — Homo neanderthalensis, যারা প্রায় ৪ লাখ বছর আগে থেকে ৪০ হাজার বছর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে ছিল। তারা ছিল শক্তিশালী, ঠান্ডা আবহাওয়ার উপযোগী, আগুন ব্যবহারকারী এবং এমনকি সমাধি প্রথা পালনকারী। তারা আধুনিক মানুষের সঙ্গে জেনেটিক মিশ্রণেও (interbreeding) অংশ নিয়েছিল।
এই সময়েই আরেকটি প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল — Denisovan, যারা একই সময়ে বাস করত এবং তাদেরও আধুনিক মানুষের সঙ্গে কিছু জেনেটিক সংযোগ ছিল।
অবশেষে, প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে, এক নতুন প্রজাতির আবির্ভাব ঘটল — Homo sapiens, অর্থাৎ আধুনিক মানুষ। তারা ধীরে ধীরে আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র পৃথিবীতে।
এদিকে, যেই শাখা থেকে মানুষ আলাদা হয়ে গেল, সেই শাখা থেকে জন্ম নিল শিম্পাঞ্জি ও বনোবো। এদের সঙ্গে মানুষের জেনেটিক মিল প্রায় ৯৮% খুঁজে পাওয়া যায়।

নীচে মানুষের বিবর্তনের ধারাবাহিকতা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-
১। ডাইনোসর –>>> ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে প্রাইমেটদের উদ্ভব (প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে)
২। প্রাইমেটদের থেকে বানর ও এপ-এর বিভাজন (প্রায় ২৫–৩০ মিলিয়ন বছর আগে)
৩। এপ ও মানুষের পূর্বপুরুষ (প্রায় ৭–১০ মিলিয়ন বছর আগে): Last Common Ancestor (LCA)
৪। হোমিনিন লাইন (প্রায় ৭ মিলিয়ন বছর আগে থেকে): মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষদের এই লাইনটিকে হোমিনিন (Hominin) বলা হয়। এর গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো হলো—
- Sahelanthropus tchadensis (প্রায় ৭ মিলিয়ন বছর আগে): মানুষের প্রাচীনতম সম্ভাব্য পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হয়।
- Australopithecus (৪–২ মিলিয়ন বছর আগে): আংশিক সোজা হয়ে হাঁটত, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করত।
- Homo habilis (২.৪–১.৪ মিলিয়ন বছর আগে): প্রথম হাতিয়ার ব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত।
- Homo erectus (১.৯ মিলিয়ন – ১ লক্ষ বছর আগে): সম্পূর্ণ সোজা হয়ে হাঁটত এবং আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
- Homo neanderthalensis- এর বসবাস করত ৪ লাখ বছর আগে –প্রায় ৪০,০০০ বছর আগ পর্যন্ত ।
- Denisovan- এরা প্রায় ৪ লাখ বছর আগে –প্রায় ৪০,০০০ বছর আগ পর্যন্ত ছিল।
- Homo sapiens (প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে থেকে): আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটে এবং তারা ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব প্রান্তে বিস্তার লাভ করে।

২। ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত মানুষের মত দেখতে এইসব প্রাণীরা কি আদম আঃ এর বংশধর?
ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত প্রায় ৩ লাখ বছর আগে থেকে বসবাসরত আধুনিক মানুষ অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্সরা (Homo sapiens) কি আদম আঃ এর বংশধর কিনা তা জানতে হলে আমাদেরকে জানতে আদম আঃ কবে পৃথিবীতে এসেছিলেন। এ বিষয়ে একদম সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কুরআনে একটি আয়াত হতে দেখা যায় আদম আঃ, নূহ এবং ইব্রাহীম আঃ একে অন্যের সাথে বংশানুক্রমে সংযুক্ত ছিলেন। তাঁদের ব্যাপারে ذُرِّيَّة শব্দটি ব্যাবহার করা হয়েছে, এই শব্দটি দিয়ে বোঝায় সন্তান-সন্ততি, বংশধর।
সূরা আল ইমরানের ৩৩-৩৪ নাম্বারে বলা হয়েছে-
নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ ও ইবরাহীমের পরিবারকে এবং ইমরানের পরিবারকে সৃষ্টিজগতের উপর মনোনীত করেছেন। তারা একে অপরের বংশধর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
অর্থাৎ আদম,নূহ এবং ইব্রাহীম আঃ একজন আরেকজনের সাথে বংশানুক্রমে সংযুক্ত। তাফসীর ইবনে কাথীরে বলা হয়েছে আদম আঃ এর দশ প্রজন্ম পরে নূহ আঃ আগমন করেছিলেন।
ইবন কাথীর তাঁর তাফসীরে নূহ (আ.)-এর বংশপরিচয়ের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:
নূহ, লামকের ছেলে, লামক মথূশাল্লাখের (মেথুসালাহ) ছেলে, মথূশাল্লাখ খানোখের (হেনোক) ছেলে, খানোখ ইয়াদের ছেলে, ইয়াদ মাহলালীলের ছেলে, মাহলালীল কাইনানের ছেলে, কাইনান আনুশের ছেলে, আনুশ শীথের ছেলে, শীথ আদমের ছেলে (আলেহিমুস সালাম)।
আদম → শীথ → আনুশ → কাইনান → মাহলালীল → ইয়াদ → খানোখ (ইদ্রিস আঃ) → মথূশাল্লাখ → লামেক → নূহ (আঃ)
নবী আ এর আগমনের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করলে আদম আঃ কতদিন আগে পৃথিবীতে তার কিছুটা ধারনা করা যায়। নবীদের ধারাবাহিকতা মোটামুটিভাবে-
প্রধান নবীদের ক্রম সাধারণত এভাবে বোঝা যায়: আদম → ইদ্রিস → নূহ → হুদ → সালিহ → ইব্রাহিম → লুত → ইসমাঈল → ইসহাক → ইয়াকুব → ইউসুফ → শুয়াইব → মূসা → হারুন → দাউদ → সুলাইমান → ইউনুস → যাকারিয়া → ইয়াহিয়া → ঈসা → মুহাম্মদ (তাঁদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক)।

আনুমানিক কালক্রম উপরোক্ত তথ্যের ভিত্তিতে, একটি আনুমানিক কালক্রম নিম্নরূপ, যদিও সুনির্দিষ্ট তারিখগুলো অনুমানভিত্তিক-
- আদম: ~৬,০০০–১২,০০০ বছর আগে (৪০০০–১০,০০০ খ্রিস্টপূর্ব, অনুমানভিত্তিক, ইহুদি-খ্রিস্টান বংশতালিকার ভিত্তিতে)।
- নূহ: ~৩,০০০–৮,০০০ খ্রিস্টপূর্ব (আদমের পর কয়েক শতাব্দী বা সহস্রাব্দ পরে)।
- ইব্রাহিম: ~২০০০–২৫০০ খ্রিস্টপূর্ব।
- মূসা: ~১৪০০–১২০০ খ্রিস্টপূর্ব।
- দাউদ/সুলাইমান: ~১০০০–৯০০ খ্রিস্টপূর্ব।
- ঈসা: ~৪ খ্রিস্টপূর্ব–৩০ খ্রিস্টাব্দ।
- মুহাম্মদ সাঃ : ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ–৬৩২ খ্রিস্টাব্দ।
- বর্তমান : মুহাম্মদের মৃত্যুর পর থেকে আনুমানিক ১,৪০০ বছর।
অর্থাৎ আমরা বলতে পারি আদম আঃ পৃথিবীতে আগমনের সম্ভাব্য সময় ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ বছর। অথচ ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী Homo sapience বা মানুষ প্রায় ৩ লাখ বছর আগ থেকে পৃথিবীতে ছিল। অন্যদিকে কুরআনে আদম আঃ মাটির উপাদান থেকে সরাসরি তৈরী করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং আদম আঃ, নূহ এবং ইব্রাহীম আঃ কে পরস্পরের বংশধর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই আদম আঃ ৩ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন এমনটি হবার সম্ভাবনা নাই।
৩। আদম আঃ এর আগে কি পৃথিবীতে অন্যান্য বুদ্ধিমান জাতি বসবাস করত? আদম আঃ থেকে Hominid প্রাণীদের রিপ্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়েছিল?
কাজেই আমরা বলতে পারি পুরানো যেই ফসিলগুলো পাওয়া যায় সেগুলো সম্ভবত আদম আঃ আর হাওয়া আঃ এর বংশধর নয়। বরং সেগুলো আদম আঃ পৃথিবীতে আগমনের আগে বসবাসরত মানুষের মত অন্যান্য প্রজাতি।
প্রশ্ন হচ্ছে-
১। আদম আ এর আগে পৃথিবীতে কি মানুষের মত অন্যান্য প্রাণী বসবাস করত?
২। তারা কি বুদ্ধিমান ছিল?
৩। আল্লাহ কি আগের সৃষ্টি প্রাণীদের বদলে আদম আঃ মাধ্যমে মানুষ বা আল-ইনসান নামের নতুন স্পেসিস সৃষ্টি করেছিলেন?
আমরা জানি পৃথিবীতে অনেক আগে থেকেই জ্বীন জাতি বসবাস করত। এই বিষয়ে কুরআন, হাসীদ এবং তাফসীর গ্রন্থে অনেক তথ্য পাওয়া। তবে পৃথিবীতে মানুষের মত দেখতে অন্যান্য প্রাণী বসবাস করত কি না তা নিয়ে কুরআন বা হাদীসে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সূরা আল বাকারার ৩০ নাম্বার আয়াতে মানুষ সৃষ্টির সূচনার সময়কার কিছু তথ্য পাওয়া যায় যেখানে মহান আল্লাহ মানুষকে ‘খলীফা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই ‘খলীফা’ শব্দের ব্যাক্ষ্যায় অনেক তাফসীরকারকগণ আদম আ এর অনেক আগেই মানুষের মত অন্যান্য প্রাণীর অস্ত্বিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন।
সূরা আল-বাকারা – আয়াত ৩০ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে:
আর স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে একজন খলিফা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।’ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে বসাবেন, যে সেখানে অশান্তি সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত করবে? অথচ আমরা আপনার প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা ঘোষণা করি ও আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করি।’ তিনি বললেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।’
এই আয়াতে আল্লাহ মানবজাতিকে خَلِيفَة হিসেবে ঘোষণা দেন। ফেরেশতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে মানুষ পৃথিবীতে অশান্তি (ساد) সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত (سفك الدماء) করবে। আল্লাহ তাদের জবাবে বলেন, “আমি যা জানি, তোমরা জানো না” — যার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে মানব সৃষ্টির পেছনে কোন একটা মহান ও গভীর উদ্দেশ্য রয়েছে যা ফেরেশতাদের জ্ঞানের বাইরে। এই আয়াতে দুটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ-
১। খলিফা বলতে কি বুঝায়?
২। ফেরেশতারা কিভাবে বলতে পারল মানুষ পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে?
আসুন আমরা দেখি আরাবিক ডিকশনারি অনুযায়ী খলিফা বলতে কি বুঝায়?
خَلِيفَةً (খলিফাহ) শব্দের অর্থ – আরবি অভিধান অনুযায়ী: মূল ধাতু: خ ل ف (খ–ল–ফ)। এই ধাতুর মূল ধারণা হলো: পেছনে আসা, কারো উত্তরসূরি হওয়া, অথবা কারো প্রতিনিধি হওয়া। ক্লাসিকাল আরবি অভিধান অনুযায়ী:
1. Lisān al-‘Arab (লিসানুল আরাব): খলিফাহ হল সেই ব্যক্তি, যে অপর একজনের পরে আসে এবং তার স্থান গ্রহণ করে। পৃথিবীতে খলিফাহ হল আল্লাহর প্রতিনিধি, যে তাঁর আদেশ ও নিষেধ বাস্তবায়ন করে।
2. আল-মুফরাদাত (Al-Mufradāt) – রাগিব আল-আসফাহানী:
বাংলা অর্থ: খিলাফাহ মানে হলো অন্য কারো পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করা—হয় সেই ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকার কারণে, অথবা মৃত্যুবরণ করায়।
خَلِيفَة মূল ধাতু (خ ل ف)— প্রতিনিধি / উত্তরসূরি / প্রতিনিধি শাসক / স্থলাভিষিক্ত/ পেছনে আসা, কাউকে অনুসরণ করা
তারমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি খলিফা শব্দের অর্থ বেশ ব্যাপক এবং আরবীতে এই শব্দটি দিয়ে প্রতিনিধি / উত্তরসূরি / প্রতিনিধি শাসক / স্থলাভিষিক্ত, পেছনে আসা, কাউকে অনুসরণ করা ইত্যাদি বুঝায়।
ইমাম কুরতুবি এই আয়াতে خَلِيفَة শব্দের বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন:
- আদম (আ.) আল্লাহর প্রতিনিধি, যিনি আল্লাহর নির্দেশনায় পৃথিবী শাসন করবেন।
- আদম (আ.) জিন বা অন্য কোনো সৃষ্টির উত্তরসূরি, যারা আদমের আগে পৃথিবীতে বসবাস করেছিল এবং অশান্তি ও রক্তপাত ঘটিয়েছিল।
- মানবজাতির ধারাবাহিক উত্তরসূরিদের শুরু, অর্থাৎ এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম আসবে।
ইবনে কাথীর বলেছেন- خَلِيفَة (খলীফা) এর অর্থ এমন জাতি যারা একে অপরের পরে আসবে। পক্ষান্তরে মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা ও প্রতিনিধি এ কথা বলা ভুল।
এখানে উল্লেখ্য ফেরেশতারা এমন জাতির কথা আল্লাহকে বলেছিল যারা অশান্তি সৃষ্টি করার পাশাপাশি ও রক্তপাতও ঘটাবে। জ্বীন জাতির শরীরে রক্ত থাকে না, তারা নূর বা আলো জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরী। তাদের শরীরে রক্ত নেই। কুরআন স্পষ্টভাবে বলে যে, জিনকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে:
- সূরা আর-রাহমান (৫৫:১৫): “তিনি জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াহীন অগ্নিশিখা থেকে।”
- সূরা আল-হিজর (১৫:২৭): “আর জিনকে আমি সৃষ্টি করেছি এর আগেই ধূম্রহীন অগ্নিশিখা থেকে।”
কাজেই ফেরেশতারা যাদের কথা বলেছিল তারা জ্বীন জাতি নয়। ফেরেশতারা এমন জাতির কথা বলেছিল যারা মানুষের মত ইতিপূর্বে মারামারি করত এবং তাদের দেহে রক্ত ছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মানুষের আগে যে বিভিন্ন জাতি ছিল তার কথা তাফসীর কারকগন উল্লেক করেছেন।
ইবন কাসির তাঁর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:
“জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছিল হযরত আদম (আ.)-এর আগে। আর তাদের আগেই পৃথিবীতে ছিল হিন ও বিন। তখন আল্লাহ জিনদেরকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাশালী করলেন, ফলে জিনরা তাদের হত্যা করে, বিতাড়িত করে, এবং পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিজেরা এখানে বসবাস শুরু করল।” (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবন কাসির, পৃ. ৫০)
আল-মাসউদী (মুরূজুয-যাহাব, খণ্ড ১):
তিনি লিখেছেন, আদমের আগে আল্লাহ বহু জাতি ও ভিন্ন রূপের সৃষ্টি করেছিলেন—যারা কেউ শান্ত, কেউ আবার সহিংস ও রক্তপাতকারী ছিল।
আল-মাসউদী লিখেছেন:
“আল্লাহ আদম (আ.)-এর আগে ২৮ জাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন, যাদের রূপ ছিল ভিন্ন ভিন্ন।”
তিনি কয়েকটি বর্ণনা করেছেন—
- কারও ছিল ডানা, তাদের কথা ছিল বজ্রধ্বনির মতো।
- কারও দেহ সিংহের মতো, মাথা পাখির মতো, চুল ও লেজ ছিল।
- কারও দুটি মুখ ছিল—একটি সামনে, আরেকটি পেছনে—এবং বহু পা ছিল।
- কারও অর্ধেক ছিল মানুষের মতো, একটি হাত ও একটি পা, আর তাদের কথা ছিল সারস পাখির ডাকের মতো।
- কারও মুখ মানুষের মতো, পিঠ কচ্ছপের মতো, মাথায় শিং ছিল, কণ্ঠস্বর ছিল কুকুরের ডাকের মতো।
- কারও সাদা লোম ছিল, লেজ ছিল গরুর মতো।
- কারও দাঁত ছিল ছুরির মতো ধারালো, আর কান ছিল দীর্ঘ।
(আল-মাসউদীর তারিখুল উমাম)
অর্থাৎ আমরা ‘খলীফা’ শব্দের ব্যাক্ষ্যা এবং তাফসীকারকদের বক্তব্য থেকে বলতে পারি আদম আঃ পৃথিবীতে আগমনের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জাতি পৃথিবীতে বসবাস করেছিল যারা মানুষের কাছাকাছি স্বভাবের ছিল এবং কালের পরিক্রমায় তারা পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, ফসিল রেকর্ড থেকে কিন্তু এমনটাই প্রমাণিত হয়।
৪। বনী-আদমের সাথে অন্যান্য Hominid দের পার্থক্য কি?
মূল পার্থক্য হচ্ছে বুদ্ধিমত্তায়।
ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত Hominid প্রাণিগুলো শারিরীক দিক দিয়ে মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, কিন্তু মুল পার্থক্য হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বায়। তারা জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধিমত্ত্বা, ভাষা, শিল্প, সংসকৃতিতে মানুষের মত ছিল না। তাই মানুষের অনেক আগে থেকে পৃথিবীতে বসবাস করেও তারা সত্যিকার কোন সভ্যতা গোড়ে তুলতে পারে নি। পৃথিবীতে সব সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে আদম আর হাওয়া আ এর বংশধরের মাধ্যমে বিগত ৬০০০ থেকে ১২,০০০ হাজার বছরের মধ্যে। বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষের পূর্বপুরুষ ৩ লাখ বছর আগে বছর থেকে বিচরণ করলেও সমাজ আর সভ্যতা গড়ে উঠেছে মাত্র বিগত ৫-৬ হাজার বছর সময়ের মধ্যে।
ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত এইসব Hominid প্রাণীদের গঠন আকৃতি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখা গেছে এর দুই পায়ের উপর ভর করে চলতে পারত এবং অনেকেই সোজা হয়ে দাড়াতে পারত। তারা আগুনের ব্যাবহার এবং বিভিন্ন যন্ত্র এবং অস্ত্র ব্যাবহার করতে পারত।
কিন্তু তাদের মস্তিষ্কের আকৃতি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখা যায় প্রায় ৩ লাখ থেকে ৭০ লাখ বছর আগে বসবাসকারি Sahelanthropus tchadensis থেকে শুরু করে Homo Erectus পর্যন্ত প্রজাতিগুলোর মস্তিষ্কের আকার বর্তমান সময়ের শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা ওরাঙওটান – এর ব্রেইনের সমান, গড়ে ৩৫০ থেকে ৫০০ সিসি ।
উল্লেখ্য মানুষের ব্রেইনের ভলিউম প্রায় গড়ে ১৩০০ থেকে ১৪০০ সিসি। শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা ওরাঙওটান ব্রেইনের ভলিউম প্রায় গড়ে ৩৫০ থেকে ৫০০ সিসি ।
কাজেই ব্রেইনের আকারের মাপ থেকে আমরা বলতে পারি Sahelanthropus tchadensis থেকে শুরু করে Homo Erectus পর্যন্ত প্রজাতিগুলোর বুদ্ধিমত্তা এখনকার শিম্পাঞ্জি, গরিলা থেকে বেশী হবার কথা নয়। কাজেই এরা আসলে ভিন্ন প্রজাতির এপ জাতীয় প্রাণী ছিল, খুব বেশী বুদ্ধিমান ছিল না।
ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির ব্রেইনের আকার-
| প্রজাতি | গড় মস্তিষ্কের আকার (cc) |
| সাহেলানথ্রোপাস ট্যাডেনসিস | ~৩৫০–৩৭০ cc |
| অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেন্সিস | ~৪০০–৫০০ cc |
| হোমো হ্যাবিলিস | ~৫১০–৬০০ cc |
| হোমো ইরেক্টাস | ~৬০০–১,১০০ cc |
| হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস (নিয়ান্ডারথাল) ও ডেনিসোভান | ~১,২০০–১,৭৫০ cc |
| হোমো স্যাপিয়েন্স | ~১,৩০০–১,৪০০ cc |
অন্যদিকে ৪ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বসবাসকারী হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস (নিয়ান্ডারথাল) ও ডেনিসোভান হচ্ছে মানুষের খুব কাছাকাছি প্রজাতি, তারা মানুষের মতই উভয়ই দুই পায়ের উপর ভর করে চলাফেরা করত — অর্থাৎ তারা দ্বিপদী (bipedal) ছিল। কিন্তু এদের এর মস্তিষ্কের সাইজ (১২০০-১৭৫০ সিসি) মানুষের মস্তিষ্কের সমান বা কিছুটা বড় ছিল। কাজেই এরা মানুষের মত বুদ্ধিমান হবার কথা। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে তাদের মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারণগত দিক থেকে অনেক পার্থক্য ছিল। নিয়ান্ডারথালের ব্রেইনের আকৃতি মানুষের ব্রেইনের চাইতেও কিছুটা বড় হলেও তাদের ভাষা ও যোগাযোগের ক্ষমতা সীমিত ছিল এবং সম্ভবত তাদের ভাষার জটিলতা আধুনিক মানুষের মতো উন্নত ছিল না। তাদের বিমূর্ত চিন্তা এবং সৃজনশীলতা তুলনামূলক কম ছিল, ফলে তারা শিল্পকলা বা জটিল উদ্ভাবনে খুব বেশি এগোয়নি। যদিও তারা শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং শিকার ও কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারত, তাদের সামাজিক গোষ্ঠী সাধারণত ছোট এবং সহজ ছিল। অপরদিকে, আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক ভাষা, সামাজিক সহযোগিতা, জটিল চিন্তা ও সৃজনশীলতার জন্য বিশেষভাবে গঠিত, যা তাদেরকে জটিল সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি বিকাশে সক্ষম করেছে এবং পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করতে সাহায্য করেছে। অর্থাৎ, নিয়ান্ডারথালরা প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকতে দক্ষ হলেও, আধুনিক মানুষের তুলনায় তাদের বুদ্ধিমত্তা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সীমিত ছিল।
নীচে মানুষের মস্তিষ্কের সাথে নিয়ানডারথাল ও ডেনিসোভান প্রজাতির ব্রেইনের গঠনগত পার্থক্য দেখানো হল-
| দিক | নিয়ানডারথাল ও ডেনিসোভান | আধুনিক মানুষ |
| মস্তিষ্কের আকার (গড় ভলিউম) | ~১,৫০০ cm³ (আধুনিক মানুষের চেয়ে বড়) | ~১,৩৫০ cm³ (সামান্য ছোট, কিন্তু আরও দক্ষ সংগঠন) |
| স্নায়ু কোষের বৃদ্ধি (TKTL1 জিন) | TKTL1 জিনের মিউটেশন নেই; কম নিউরাল প্রোজেনিটর কোষ, ফলে নিউরন কম তৈরি হয়। | TKTL1 জিনে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড পরিবর্তন; আরও প্রোজেনিটর কোষ, নিউকরটেক্সে (জ্ঞানীয় অংশ) আরও নিউরন। |
| কোষ বিভাজনের নির্ভুলতা (মেটাফেজ সময়) | সংক্ষিপ্ত মেটাফেজ; ক্রোমোজোম ভুল বেশি (KIF18A, KNL1, SPAG5 জিনের পুরাতন সংস্করণ)। | দীর্ঘ মেটাফেজ; কম ভুল, স্বাস্থ্যকর মস্তিষ্ক বিকাশ (এই জিন পরিবর্তনগুলো নিয়ানডারথাল/ডেনিসোভান থেকে আলাদা)। |
| মস্তিষ্কের সংগঠন | বড় ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স (চোখ বড় বলে) এবং শারীরিক নিয়ন্ত্রণের অংশ; সামাজিক জ্ঞানের জন্য কম জায়গা। | বড় প্যারিয়েটাল লোব (সামাজিক ও সেন্সরি প্রসেসিং); ভিজ্যুয়াল অংশ ছোট। |
| মস্তিষ্ক রসায়ন (ADSL এনজাইম) | ADSL এনজাইম স্থিতিশীল; কম প্রতিযোগিতামূলক আচরণ। | ADSL-এ অ্যালানিন-টু-ভ্যালিন পরিবর্তন; এনজাইম অস্থিতিশীল, মস্তিষ্কে উচ্চ সাবস্ট্রেট (SAICAr, S-Ado), সম্ভবত প্রতিযোগিতায় সুবিধা। |
উপরের আলোচনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হোমো-সাপিয়েন্সের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রাইমেটরাও বুদ্ধিমত্ত্বা এবং চিন্তাশক্তিতে মানুষের মানুষের মত ছিল না বরং মানুষের চাইতে নিম্ন মানের ছিল। তারমানে আমরা বলতে পারি নিয়ান্ডারথালর ও ডেনিসোভানরা মানুষের মত দেখতে হলেও মানুষের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ছিল।

এবার আসা যাক হোমো স্যাপিয়েন্স নিয়ে আলোচনায়, যাদেরকে বলা হয় আধুনিক মানুষ-
প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্স (প্রায় ৩,০০,০০০–১,০০,০০০ বছর আগে)
প্রায় ৩ লাখ বছর আগে আফ্রিকায় প্রথম আধুনিক মানুষের মত প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে। মরক্কোর জেবেল ইরহৌদ এর মতো স্থান থেকে পাওয়া জীবাশ্ম হলো এই প্রজাতির প্রাচীনতম নমুনার মধ্যে অন্যতম। তাদের মস্তিষ্কের আয়তন প্রায় ১৪০০ ঘন সেন্টিমিটার (cc) এর কাছাকাছি হলেও আকৃতি ছিল লম্বাটে এবং কিছুটা “আদি মানুষের মতো”। মস্তিষ্কের পিছনের অংশ তুলনামূলকভাবে বড় ছিল, এখনকার মানুষের মত ছিল না।
মধ্য পর্যায়ের হোমো স্যাপিয়েন্স (প্রায় ১,৫০,০০০–৫০,০০০ বছর আগে)।
এই সময়ের ফসিল যেমন ইথিওপিয়ার হের্টো (Herto, ~১,৬০,০০০ বছর আগে) থেকে পাওয়া কঙ্কাল। তাদের মস্তিষ্কের আকার আধুনিক মানুষের সমান হলেও আকৃতি এখনকার মতো গোলাকার হয়নি। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে চওড়া ও উঁচু হতে থাকে, বিশেষ করে কপালের অংশ ও মস্তিষ্কের সামনের লোব (frontal lobe)।
আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স (প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে থেকে বর্তমান)
ইউরোপ ও এশিয়ায় পাওয়া আধুনিক মানুষের প্রাচীন ফসিল (যেমন ক্রো-ম্যাগনন মানুষ, প্রায় ৩০–৪০ হাজার বছর আগে)।তাদের মস্তিষ্ক ছিল গড়পড়তা ১৩৫০–১৪৫০ cc, যা আধুনিক মানুষের কাছাকাছি।আকৃতি ছিল অপেক্ষাকৃত গোলাকার (globular), কপাল উঁচু ও মস্তিষ্কের সামনের অংশ (prefrontal cortex) বড়, যা উচ্চ বুদ্ধিমত্তা, ভাষা ও জটিল চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পর্কিত। ক্রো-ম্যাগননরা গুহাচিত্র (Cave Paintings) এঁকেছিল, যেমন: Lascaux Cave (France) – এখানে বিশাল বিশাল পশুর ছবি পাওয়া গেছে। তারা মূর্তি ও অলংকার তৈরি করত (হাড়, পাথর, দাঁত দিয়ে)। তারা বড় পশু শিকার করতে পারত। তারা গুহার মধ্যে, পাহাড়ে বসবাস করত। কিন্তু তারা কোন সভ্যতা তৈরী করতে পারে নি।
৫। Homo sapience ৩ লাখ বছর ধরে বসবাস করলেও কোন সভ্যতা গোড়ে তুলতে পারে নাই। মানব ইতিহাসের মাইলফলক: সভ্যতা, কৃষি, এবং ধাতু ইত্যাদির বিকাশ সাধিত হয়েছে আদম আ: এর বংশধরের মাধ্যমে, অন্য স্পেসিসের মাধ্যমে নয়।
আমরা যদি মানব সভ্যতার বিকাশ নিয়ে স্টাডি করি তাহলে অবাক হয়ে দেখব মানুষে ইতিহাসে সভ্যতার শুরু (Civilization) হয়েছে মাত্র ৫,০০০–৬,০০০ বছর আগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০–৩০০০)। সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে শহর গঠন, লিখন পদ্ধতি প্রশাসন, ধর্ম, এবং প্রযুক্তির বিকাশ ইত্যাদি।
আমরা যদি ইতিহাস দেখি তাহলে দেখব পৃথিবীর প্রধান প্রধান সভ্যতেগুলো হচ্ছে- মেসোপটেমীয় সভ্যতা , মিশরীয় সভ্যতা , সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা , চীনা সভ্যতা (প্রাচীন), মেসোআমেরিকার সভ্যতা , আন্দীয় সভ্যতা (দক্ষিণ আমেরিকা)।
১. মেসোপটেমীয় সভ্যতা শুরু: প্রায় ৫৫০০ বছর আগে অবস্থান: টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল (বর্তমান ইরাক ও সিরিয়া), বৈশিষ্ট্য: পৃথিবীর প্রাচীনতম লিপি—কিউনিফর্ম, চাকার আবিষ্কার, সেচব্যবস্থা, হামুরাবির আইনসংহিতা, উর ও ব্যাবিলনের মতো নগররাষ্ট্র।
২. মিশরীয় সভ্যতা শুরু: প্রায় ৫১০০ বছর আগে অবস্থান: উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা, নীল নদীর তীরে বৈশিষ্ট্য: পিরামিড নির্মাণ, হায়ারোগ্লিফিক লিপি, ফেরাউনদের রাজত্ব, গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নয়ন।
৩. সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা শুরু: প্রায় ৪৬০০ বছর আগে, অবস্থান: বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বৈশিষ্ট্য: পরিকল্পিত শহর, উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, নির্ভুল মাপ-ওজন, বাণিজ্যিক উন্নয়ন।
৪. চীনা সভ্যতা (প্রাচীন) শুরু: প্রায় ৪০০০ বছর আগে, অবস্থান: হলুদ নদী (হুয়াং হো) উপত্যকা, উত্তর চীন বৈশিষ্ট্য: ব্রোঞ্জ যুগ, রেশম বুনন, অরাকল হাড়ে লিপি, কনফুসীয় চিন্তাধারা।
৫. মেসোআমেরিকার সভ্যতা অলমেক সভ্যতা – প্রায় ৩৫০০ বছর আগে, বৈশিষ্ট্য: বিশাল পাথরের মুখাবয়ব, আদিম লিপি, “মাতৃসভ্যতা” হিসেবে পরিচিত। মায়া সভ্যতা – প্রায় ৪০০০ বছর আগে, বৈশিষ্ট্য: জ্যোতির্বিদ্যা, পিরামিড, জটিল ক্যালেন্ডার, হায়ারোগ্লিফিক লিপি।
৬. আন্দীয় সভ্যতা (দক্ষিণ আমেরিকা) শুরু: প্রায় ৫০০০ বছর আগে, বৈশিষ্ট্য: পিরামিড নির্মাণ, শহরভিত্তিক সংস্কৃতি। পরবর্তীকালে চাভিন, নাজকা ও ইনকা সভ্যতা গড়ে ওঠে। ইনকা সাম্রাজ্য: স্পেনীয়দের হাতে পতন ঘটে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে।
| সভ্যতা | আনুমানিক শুরু |
| মেসোপটেমিয়া | ৫৫০০ বছর আগে |
| মিশর | ৫১০০ বছর আগে |
| সিন্ধু | ৪৬০০ বছর আগে |
| চীন | ৪০০০ বছর আগে |
| অলমেক | ৩৫০০ বছর আগে |
| মায়া | ৪০০০ বছর আগে |
| নর্টে চিকো | ৫০০০ বছর আগে |

কৃষির শুরু (Agriculture) সময়কাল: প্রায় ১০,০০০ বছর আগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০০) অঞ্চল: প্রাচীন ফার্টাইল ক্রিসেন্ট — বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক ইত্যাদি অঞ্চল. মানুষ শিকার ও সংগ্রহশীল জীবন ত্যাগ করে ফসল চাষ ও পশুপালন শুরু করে. গম, যব, মটর, মেষ ও গবাদিপশুর গৃহপালন শুরু হয়. কৃষিই মানব ইতিহাসে স্থায়ী বসবাস এবং পরে সভ্যতার জন্মের ভিত্তি স্থাপন করে।
ধাতু ব্যবহারের শুরু (Use of Metals)
তাম্র যুগ (Chalcolithic / Copper Age): সময়কাল: প্রায় খ্রিপূ ৪৫০০–৩৩০০ প্রাচীন সমাজে তাম্র ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যদিও পাথরের ব্যবহার চলমান ছিল
ব্রোঞ্জ যুগ (Bronze Age): সময়কাল: খ্রিপূ ৩৩০০–১২০০, তাম্র ও টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরি হয় — বেশি টেকসই, মেসোপটেমিয়া, মিশর, ভারত, চীন—সবখানেই ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা গড়ে ওঠে
লোহা যুগ (Iron Age): সময়কাল: খ্রিপূ ১২০০–৫০০ এর মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়, লোহা ছিল আরও শক্তিশালী ও সহজলভ্য — কৃষি ও অস্ত্রে বিপ্লব আনে।
প্রথম প্রকৃত লিপি:
- সুমেরীয়রা (মেসোপটেমিয়া): খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালের দিকে তারা কিউনিফর্ম লিপি তৈরি করে। এটি বিশ্বের প্রথম প্রকৃত লেখন পদ্ধতি।
- মিশরীয়রা: খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালের দিকে হায়ারোগ্লিফিক্স চালু হয়।
- সিন্ধু সভ্যতা (হরপ্পা লিপি): খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালের দিকে ব্যবহৃত হত, তবে এখনো তা উন্মোচিত হয়নি।
- চীনা অরাকল বোন লিপি: খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে শাং রাজবংশে ব্যবহৃত হত, মূলত ভাগ্য গণনার কাজে।
সারাংশ (Timeline Summary):
| ঘটনাবলি | আনুমানিক সময়কাল | অঞ্চল |
| কৃষির শুরু | খ্রিপূ ৮০০০ | ফার্টাইল ক্রিসেন্ট |
| সভ্যতার শুরু | খ্রিপূ ৩৫০০–৩০০০ | মেসোপটেমিয়া, মিশর, ভারত, চীন |
| তাম্র যুগ | খ্রিপূ ৪৫০০–৩৩০০ | বিভিন্ন অঞ্চল |
| ব্রোঞ্জ যুগ | খ্রিপূ ৩৩০০–১২০০ | ইউরেশিয়া |
| লোহা যুগ | খ্রিপূ ১২০০–৫০০ | বিভিন্ন অঞ্চল |
আমরা দেখতেই পাচ্ছি, ফসিল রেকর্ডে প্রাপ্ত হোমো সাপিয়েন্সদের ৩ লাখ বছরের ইতিহাস আর বিগত ৫০০০ থেকে ৬০০০ বছর আগের ইসিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। কৃষি, সভ্যতা, লিখন পদ্ধতি এবং ধাতু ব্যবহারের মত ইতিহাসের সব বড় মাইলফলক গুলো মানুষ অতিক্রম করেছে খুব সাম্প্রতিক সময়ে। অথচ বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীতে হোমো সাপয়েন্স বসবাস করছে ৩ লাখ বছরের অধিক সময় ধরে। সাম্প্রতিক চীনের ইউনশিয়ান অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রায় এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ বছর পুরনো খুলি, যাকে “ইউনশিয়ান ২” বলা হয়, প্রাথমিকভাবে এটি হোমো ইরেকটাসের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, আধুনিক ডিজিটাল রিকনস্ট্রাকশন পদ্ধতির মাধ্যমে এটি হোমো লংগি প্রজাতির অন্তর্গত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তারমানে মানব আকৃতির বিভিন্ন প্রজাতী পৃথিবীতে মিলিয়ন বছর ধরে বসবাস করছে।
তাহলে খুব সহজেই প্রশ্ন করা যায় মিলিয়ন বছর ধরে মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করেও কেন মানুষ সত্যিকার অর্থে কোন সভ্যতা গোড়ে তুলতে পারে নি?
৬। তাহলে কি বিবর্তন তত্ত্ব সত্য?
না, ফসিল রেকর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বিবর্তন তত্ত্ব সত্য এ কথা প্রমাণিত হয় না। বিবর্তন মানে হচ্ছে এক ধরণের প্রাণী ন্যাচারাল সিলেকশন এবং মিউটেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অন্য একটি প্রাণিতে রুপান্তরিত হওয়া। ফসিল রেকর্ড থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগ থেকে বিভিন্ন ধরণের অস্তিত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়, কিন্তু ধারাবাহিক রুপান্তরের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাছাড়া ফসিল থেকে একটি প্রাণীর বুদ্ধিমত্ত্বা থেকে পুরাপুরি ধারণা পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব। অথচ বুদ্ধিমত্ত্বাই অচ্ছে এমন এক অসাধারণ বিষয় যার কারণে বনী আদম আর সব সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জি, বানরের প্রায় ৯৮% জেনেটিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অথচ শিম্পাঞ্জি, বানর এরা মানুষের তুলনায় অনেক কম বুদ্ধিমত্ত্বার প্রাণী। এরা বনের পশু আর মানুষ হচ্ছে পৃথিবীর রাজাধিরাজ। ৯৮% জেনেটিক্যাল মিল থাকা সত্ত্বেও এসব প্রাণী কোন দিক দিয়েই মানুষের সাথে তুলনীয় নয়। এর কারণ মূলতঃ একটাই সেটি হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বা, ব্রেইনের ক্ষমতা। মানুষ ও প্রাইমেটদের মধ্যে জেনেটিক সাদৃশ্য অনেক বেশি হলেও মানুষের মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আমাদেরকে অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করে তোলে।

ছবিঃ মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির প্রায় ৯৮% জেনেটিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এদের মধ্যে বুদ্ধিমত্ত্বায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য।
মানুষের ব্রেইনের সেরিব্রাল কর্টেক্সে অন্যান্য প্রাণীদের চাইতে অনেক ডেভেলপড– বিশেষ করে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal cortex) অত্যন্ত বিকশিত, যা পরিকল্পনা, যুক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। প্রাইমেটদেরও কর্টেক্স আছে, তবে মানুষের মতো এতটা ডেভেলপড নয়। মানুষের ব্রেইনে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরণ আছে, অন্যদিকে শিম্পাঞ্জীর ব্রেইনে নিউরণের পরিমান ২৮ বিলিয়ন। মানুষের মস্তিষ্কে ব্রোকা এলাকা (কথা বলার ক্ষমতা) ও ওয়ার্নিকি এলাকা (ভাষা বোঝা) অনেক উন্নত। ফলে মানুষ জটিল ভাষা তৈরি ও ব্যবহার করতে পারে, যা প্রাইমেটরা পারে না। মানুষের মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষগুলির মধ্যে ঘন ও জটিল সংযোগ আছে (Denser and more complex synaptic connections ) । এর ফলে বিভিন্ন মস্তিষ্ক অঞ্চলের মধ্যে সমন্বয় হয়, যা বিমূর্ত চিন্তা ও উচ্চতর সৃজনশীলতাকে সম্ভব করে। ফসিল রেকর্ড থেকে সীমিত পর্যায়ে যন্ত্রপাতি ব্যবহার, স্মৃতি ও সামাজিক আচরণের কিছু নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু আজকের সভ্য মানুষের মতো প্রতীকী চিন্তা, বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতির কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী মানুষের মত আকার আকৃতির মানুষ বসবাস করত ৫০,০০০ বছর আগেই। কিন্তু আমরা মানব ইতিহাসের মাইলফলক তথা সভ্যতা গঠন, কৃষি, এবং ধাতু্র ব্যাবহার এই বিষয়গুলি আলোচনা থেকে দেখেছি যে আগুলোর বিকাশ হয়েছে মাত্র বিগত ৫০০০ থেকে ৬০০০ বছরের মধ্যে। তার মানে বনী আদমের সাথে এইসব মানব আকৃতির প্রাণীদের মধ্যে অবশ্যই বিস্তর পার্থক্য আছে। তা না হলে বহু আগেই সভ্যতা, শিল্প, সাহিত্যের বিকাশ সাধিত হত।
আমার মতে আদম আঃ এর বংশধরের সাথে আগের এই সব হমিনিড প্রাণীদের মূল পার্থক্য জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্ত্বায়। বিষয়টি কুরআনেও কিছুটা ইংগিত দেয়া হয়েছে সূরা বাকারার ৩১ থেকে ৩৩ নাম্বার আয়াতে। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ আদম আ কে সৃষ্টির পরে বিশেষ জ্ঞান দান করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন-
এবং তিনি আদাম (আ.)-কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন এবং বললেন, ‘এ বস্তুগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
তারা (ফেরেশতারা) বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের কোন জ্ঞানই নেই, নিশ্চয়ই আপনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’
তিনি নির্দেশ করলেন, ‘হে আদাম! এ জিনিসগুলোর নাম তাদেরকে জানিয়ে দাও’। যখন সে এ সকল নাম তাদেরকে বলে দিল, তখন তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও গোপন কর, আমি তাও অবগত’?
এই আয়াতগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে আদম (আঃ) কে মহান আল্লাহ বিশেষ কিছু শিখিয়েছিলেন বা বিশেষ কোন জ্ঞান দান করেছিলেন যা আদম আঃ ছাড়া অন্য কারো- এমনকি ফেরেশতাদেরও যানা ছিল না। তাফসীরকারকদের মতে আল্লাহ আদম আঃ কে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বস্তুর জ্ঞান দান করেছিলেন। এই জ্ঞানই আদম আঃ অন্যান্য সৃষ্টি থেকে বিশেষভাবে আলাদা করে ফেলেছে।
তাই Sahelanthropus tchadensis, Australopithecus, Homo habilis, Homo erectus, Homo sapiens- মানুষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এই সব স্পেসিসরা কেউই আদম আঃ এর বংশধর নয়। এরা ভিন্ন ধরনের আলাদা আলাদা স্পেসিস। বনী আদমের সাথে এদের কোন বংশানুক্রমিক সম্পর্ক নেই, তা যতই শারিরীক আর জেনেটিক মিল থাকুক না কেন।
আদম আঃ যে সম্পূর্ন আলাদা সৃষ্টি এই বিষয়টি কুরআনে একদম স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে-
সূরা ছাদ ৩৮:৭১-৭২
“যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন: নিশ্চয়ই আমি মাটি থেকে একজন মানুষ সৃষ্টি করছি। অতঃপর যখন আমি তাকে পূর্ণাঙ্গ করব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যেও।”
সূরা আন-নিসা ৪:১
“হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখান থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ দু’জন থেকে বহু পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।”
উপসংহার
১। আদম আঃ জ্ঞান, বুদ্ধিমত্ত্বা, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে আগমন করেছিলেন, তিনি পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের ফসল নন। তাঁকে ‘ খলিফা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তিনি অন্যান্য Hominid প্রাণীদের রিপ্লেস করেছেন।
২। সব সভ্যতার বিকাশ সাধিত হয়েছে বিগত ৬০০০ থেকে ৭০০০ বছরের মধ্যে আদম আ এর বংশধরের মাধ্যমে।
৩। প্রায় ৩ লাখ বছর ধরে Homo sapience পৃথিবীতে বসবাস করলেও তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল না, তাই এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোন সভ্যতার বিকাশ হয় নি।
৪। শারীরিক আর জেনেটিক মিল থাকলেও বুদ্ধিমত্ত্বার পার্থক্যের কারণে দুটি প্রাণী সম্পূর্ন আলাদা রকমের হতে পারে। যেমনঃ মানুষ আর শিম্পাঞ্জী। মানুষের সাথে ৯৮ % জেনেটিক মিল থাকলেও শিম্পাঞ্জীর বুদ্ধিমত্ত্বা অনেক কম।
৫। শারীরিক আর জেনেটিক মিল থাকা- একটি প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রুপান্তরের পক্ষে নিশ্চিত কোন প্রমাণ বহন করে না, বরং এটি একটি ধারণা বা সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনার কথাই বিবর্তন তত্ত্বে আলোচনা করা হয়েছে।
কুরআন আমাদের জানায় যে আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম মানব, যাকে আল্লাহ সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে বিশেষ জ্ঞান ও সম্মান দান করা হয়েছিল। তিনি মানবজাতির পিতা, প্রথম নবী এবং পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা হিসাবে নির্বাচিত হন। আদম আ এর বংশধর থেকে আধুনিক বুদ্ধিমান মানুষের উৎপত্তি যার সত্যিকার সমাজ আর সভ্যতা গোড়ে তুলেছে। অনেক আগে থেকেই পৃথিবীতে মানুষের মত দেখতে Hominid প্রাণীরা বসবাস করত, কিন্তু তারা মানুষের মত বুদ্ধিমান ছিল না। তাদের ব্রেইনের আকৃতি আর গঠন আলাদা ধরণের ছিল। তারা আদম আঃ বংশধরদের থেকে আলাদা। তারা কোন সভ্যতা বা Civilization গোড়ে তুলতে পারে নি। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা, শিল্প-সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে আদম আ এর বংশধরের মাধ্যমে। বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে যে বিষয়গুলো আমাদের শেখানো হচ্ছে সেগুলো মানুষের ধারণার অংশ। অকাট্য ভাবে প্রমাণিত বিষয় নয়।
Related Post-
বিবর্তন তত্ত্ব বনাম আদম হাওয়া তত্ত্ব-১
Reference:
- Smithsonian National Museum of Natural History
“Human Evolution Timeline Interactive.”
https://humanorigins.si.edu/evidence/human-evolution-timeline-interactive
(মানব বিবর্তনের ধাপসমূহের নির্ভরযোগ্য টাইমলাইন — Sahelanthropus, Australopithecus, Homo habilis, erectus, neanderthalensis, sapiens ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ) - Ibn Kathir, Tafsir al-Qur’an al-‘Azim, Vol. 8, Dar al-Taybah edition, commentary on Surah Nuh (71:1).
- Ibn Kathir, Al-Bidaya wa’l-Nihaya, Vol. 1, Dar al-Fikr edition, p. 91.
- Al-Tabari, Tarikh al-Rusul wa’l-Muluk (History of Prophets and Kings), Vol. 1.
- Ibn Manzur, Lisān al-‘Arab, root: خ ل ف, Vol. 9, p. 83, Dar Sadir edition.
- Al-Raghib al-Asfahani, Al-Mufradāt fī Gharīb al-Qur’ān, entry: خَلِيفَة, Dar al-Ma‘rifah edition.
- Smithsonian National Museum of Natural History – Human Evolution Evidence: Brain Size Over Time.
https://humanorigins.si.edu/evidence/human-evolution-evidence - Neubauer, S. et al. (2018). “The Evolution of Modern Human Brain Shape.” Science Advances, 4(1), eaao5961.
- Prüfer, K. et al. (2014). “The Complete Genome Sequence of a Neanderthal from the Altai Mountains.” Nature, 505, 43–49.
- Hublin, J.-J., & Stringer, C. (Eds.). (2012). Neanderthals Revisited: New Approaches and Perspectives. Springer.
- Florio, M. et al. (2018). “Human-Specific Gene ARHGAP11B Promotes Basal Progenitor Amplification and Neocortex Expansion.” Science, 347(6229), 1465–1470.