পবিত্র কুরানের বক্তব্য অনুযায়ী মানব জাতির উৎপত্তি হয়েছে আদম-হাওয়া থেকে। কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী মানব জাতি পর্যায়ক্রমে একটি আদিম কমন পূর্বপুরুষ থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষে পরিণত হয়েছে, আদম হাওয়া থেকে নয়।
অথচ কুরানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে-
সূরা আন-নিসা (৪:১)
“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একক ব্যক্তি (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখান থেকেই তাঁর সঙ্গিনী (হাওয়া) সৃষ্টি করেছেন, আর উভয় থেকে বহু পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন…”
ডারউইন তত্ত্ব
১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন তার বই ‘ অন দ্য অরিজিন অফ স্পেসিস’ এ বিবর্তনের ধারনা প্রকাশ করেন। যেখানে বলা হয় মানুষ সহ পৃথিবীর সকল প্রাণী একটি সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকগুলো প্রজাতিতে বিভক্ত হয়েছে। অর্থাৎ সব জীবেরই পূর্বপুরুষ এক বা কয়েকটি সাধারণ জীব যারা ধাপে ধাপে পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের নানা প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে তিনি বলেছিলেন “Natural Selection” (প্রাকৃতিক নির্বাচন)।
মানুষের বিবর্তন নিয়ে ডারউনের এই বইয়ে তেমন কিছু লিখা না হলেও ১৮৭১ সালে “The Descent of Man, and Selection in Relation to Sex” বইতে ডারউইন বিস্তারিতভাবে মানব বিবর্তনের আলোচনা করেন। এই বইতে তিনি বলেন- মানুষ ও আধুনিক বানরের একটি কমন পূর্বপুরুষ ছিল, যেখান থেকে তারা আলাদা পথে বিবর্তিত হয়েছে। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্নত প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে।
বিবর্তন সংক্রান্ত ডারউনের এই ধারনাটিই মূলত সারা পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে সুপ্রতিষ্টিত একটি বিষয়।

ডারউইন তত্ত্বের গোড়ায় গলদ
প্রথম কথা হলো- পৃথিবীতে কিভাবে প্রাণের উৎপত্তি হলো? ডারউইন, কিভাবে সরল প্রাণী ধীরে ধীরে জটিল প্রাণীতে পরিণত হল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন, কিন্তু কিভাবে প্রাণের উদ্ভব হলো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেননি। অথচ, এই প্রশ্নটি হচ্ছে মানিব জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন। ডারউইন মূলত বায়োলজিক্যাল এভুলোশন নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেমিক্যাল এভুলোশন বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক জড় উপাদানগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কিভাবে জীবন তৈরী করেছিল তা ব্যাক্ষ্যা করেন নি। ডারউইন কোষের অত্যন্ত জটিল গঠন সম্পর্কে কোন ধারণা রাখতেন না, কারণ তাঁর সময়ে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হয় নি। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হয় ১৯৩০-এর দশকে, এরপর থেকেই মানুষ কোষের অত্যন্ত জটিল গঠন নিয়ে ধারণা পেতে শুরু করে।
পৃথিবীতে কিভাবে মানুষের উৎপত্তি হলো তার উত্তর প্রথমেই খুঁজতে হবে মানুষের তথা সমগ্র প্রাণীজগতের গঠন একক “ কোষের” উৎপত্তি নিয়ে। যদি প্রকৃতিতে বিভিন্ন জীবনহীন উপাদান একত্রিত হয়ে ‘জীবন্ত’ কোষ তৈরী হতে পারে তবেই প্রাণের উৎপত্তি হতে পারে, যে প্রক্রিয়াকে ইংরেজীতে বলা হয় Abiogenesis।
জীবনের উদ্ভব নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা-
প্রাণের উদ্ভব বিষয়ে ১৯৫২ সালে রসায়নবিদ সর্বপ্রথম স্ট্যানলী মিলার একটি রাসায়নিক পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি ভৌত রসায়নবিদ হ্যারল্ড ক্লেটন উরের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা করেছিলেন বলে ‘মিলার-উরের’ পরীক্ষা নামে পরিচিত। এই পরীক্ষাটি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পাদিত হয় ও ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। মিলার চেয়েছিলেন পৃথিবীর আদিম পরিবেশে কিভাবে প্রাণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান যেমনঃ এমাইনো এসিড তৈরী হতে পারে তা দেখার জন্য।
বিজ্ঞানীদের ধারনা আদিম কালে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল সম্ভবত মিথেন, হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া সমৃদ্ধ ছিল। তখন পৃথিবীর বায়ুতে অক্সিজেন খুব একটা থাকার কথা নয়, কারণ পৃথিবীতে প্রথম অক্সিজেন তৈরি হয়েছে মূলত সালোকসংশ্লেষী ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে।
আকাশে বিদ্যুৎ ক্ষরণ, শক্তিশালী সৌর বিকিরণ, ঘন ঘন আগ্নেয়গিরির অগ্নুপাতের কারণে সাগরের পানির ভেতরে কোন ভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়েছিল, যার ফলাফল হিসেবে পানির ভেতরে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল। স্ট্যানলী মিলার বিজ্ঞানীদের এই ধারণাকে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলেন।

তাই তিনি উপরের ছবির মত একটি ফ্লাস্ক এবং টিউব সহ একটি বদ্ধ কাচের যন্ত্র ডিজাইন করেছিলেন। যার একটি অংশে তিনি মূল বায়ুমণ্ডল হিসাবে মিথেন, হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া গ্যাস দিয়ে পূর্ণ করেছিলেন। আর আরেকটি অংশে পানি রেখেছিলেন । খেয়াল রাখা হয়েছিল ফ্লাস্কে যেন কোন অক্সিজেন না থাকে, কারণ আদিম পৃথিবীতে প্রথমে কোন অক্সিজেন ছিল না। দুটি ইলেক্ট্রোডের মাধ্যমে গ্যাসের চেম্বারের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্ষরণের ব্যবস্থা করা হয় এবং ফ্লাস্কে উৎপন্ন হওয়া পদার্থগুলোকে ঠান্ডা আর তরল করার করার পর একটি জারে সংগ্রহ করা হয়।
এই এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে উৎপন্ন হওয়া যৌগকে পরে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে তাতে প্রায় ১১ ধরনের Amino acid (যার মধ্যে কিছু জীবদেহে পাওয়া যায়, যেমন: glycine, alanine, aspartic acid), Simple carboxylic acid, Hydrocarbon, Hydrogen cyanide (HCN) ও formaldehyde (HCHO) — যেগুলো জীবনের জন্য প্রাথমিক-উপাদান (precursors) হিসেবে বিবেচিত।
মিলারের এই পরীক্ষাটি ছিল পৃথিবীর আদি কালে কিভাবে প্রাণ তৈরী হয় তার জন্য একটি মোটামোটি প্রাথমিকভাবে সফল পরীক্ষা। কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজেই কোষের ব্যাসিক উপাদান তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। তখন বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ল্যাবরেটরীতে কৃত্তিম জীবন তৈরী করতে পারবেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে Miller-Urey Experiment এর মত মোটামুটি একটি সফল পরীক্ষার পর প্রায় ৭৩ বছর অতিবাহিত হিয়ে গেছে কিন্তু বিজ্ঞানীরা আসলে আর খুব বেশী দূর আগাতে পারেন নি। কেননা প্রকৃতিতে কৃত্তিমভাবে জীবনের উপাদান তৈরি হতে পারলেও সেগুলো একত্রিত হয়ে আসলে জীবন গঠন করে না । সময়ের সাথে প্রকৃতিতে একাকি প্রাণের উদ্ভব হতে পারাটা যে কতটা জটিল আর দূরহ ঘটনা সেটিই মানুষের সামনে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে চলেছে।
পরবর্তী জটিল আলোচনায় যাবার আগে আসুন আমরা দেখি একটা কার্যক্ষম, জীবন্ত কোষের বেঁচে থাকার জন্য নূন্যতম কিকি জিনিসগুলো অপরিহার্য-
- DNA (ডি-অক্সিরাইবোজ নিউক্লিক এসিড)
- RNA (রাইবো নিউক্লিক এসিড)
- Protein and enzyme (প্রোটিন এবং এনজাইম বা অনুঘটক- যা রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটনের জন্য প্রয়োজন)
- Lipid Membrane (কোষের পর্দা)
- ATP or Energy (কোষের কাজ করার জন্য শক্তি)
- Cellular Metabolism ( কোষের মধ্যে ঘটতে থাকা নানান রাসায়নিক বিক্রিয়া)
- Cell Division ( কোষের বিভাজনের মধ্যমে নতুন কোষের সৃষ্টি)

১। DNA (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) হলো আমাদের শরীরের জেনেটিক ব্লুপ্রিন্ট বা নকশা। এটি কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে এবং এতে থাকে জীবের সমস্ত Genetic information, যেমন চোখের রঙ, রক্তের গ্রুপ, উচ্চতা ইত্যাদি কেমন হবে।
২। DNA নিজে সরাসরি কাজ করে না, বরং এটি RNA তৈরি করে। RNA (রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) হলো DNA-র বার্তাবাহক। যখন একটি কোষে কোনো protein তৈরি করতে হয়, তখন DNA থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ কপি করে mRNA (messenger RNA) তৈরি হয়। এই mRNA কোষের বাইরে গিয়ে ribosome নামক স্থানে গিয়ে Protein synthesis শুরু করে।
৩। RNA কোড অনুযায়ী অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোকে সাজিয়ে যে Protein তৈরি করে সেই Protein-গুলোই শরীরের বিভিন্ন কাজ যেমন হজম, কোষ গঠন, রোগ প্রতিরোধ, এনজাইম তৈরি ইত্যাদির দায়িত্বে থাকে। অর্থাৎ DNA হলো মাস্টার প্ল্যান, RNA হলো বার্তাবাহক, আর protein হলো বাস্তব কর্মী, যারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
৪। আর কোষের মধ্যে এই কাজগুলো চলমান থাকার জন্য চাই শক্তি বা Energy. কোষের ATP এই শক্তি বা Energy সরবরাহের কাজটি করে থাকে।
৫। কোষের উপাদানগুলো যত্র-তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেই চলবে না, বরং ঝিল্লি বা পর্দা দিয়ে আবদ্ধ প্রকোষ্টের মাধ্যে কোষের সব কিছুই একসাথে থাকতে হবে যাকে বলে Lipid Membrane। একজায়গায় আবদ্ধ অবস্থায় থাকলেই কোষের উপাদানগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে।
৬। পরিশেষে কোষটি বিভাজন এবং প্রতিলিপি তৈরীর (Self Replication) এর মাধ্যমে তার মতই আরো নতুন কোষের জন্ম দিতে পারতে হবে।
কোষের এই বিষয়গুলো যত সহজেই বর্ণনা করা হলো বাস্তবে আসলে অনেক গুনে জটিল।
উপরের আলচনা থেকে বুঝাই যাচ্ছে কোষ হচ্ছে ঠিক একটা ফ্যাক্টরির মত। যেখানে বিভিন্ন উপাদানগুলো একত্রিত হতে সুনির্দিষ্ট কাজ করে থাকে। এই কাজগুলো করার জন্য শক্তি (ATP) এবং এনজাইম (Enzyme) প্রয়োজন হয়।
আদিম পৃথিবীতে জীবন শুরুর প্রক্রিয়াটিকে কিভাবে শুরু হয়েছিল, তার বেশ কয়েকটি হাইপোথিসিস আছে-
১। কোন কোন বিজ্ঞানী মনে করেন- কোষের নির্দিষ্ট কাজ করার জন্য যেহেতু ইনফরমেশন লাগবে তাই প্রথমে জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল অর্থাৎ নিউক্লিইক এসিড বা আরএনএ (RNA) তৈরী হয়েছিল।
২। কেউ কেউ মনে করেন প্রথমে প্রোটিন তৈরী হয়েছিল। কারণ কোষের মধ্যে প্রোটিন Catalyst বা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এবং প্রোটিনের সাহাজ্য ছাড়া DNA, RNA replication বা বিভাজন হয় না।
৩। কেউ বলেন প্রথমে Cell membrane বা কোষের ঝিল্লি তৈরী হয়েছিল, কারন কোষের উপাদান গুলো একত্রে কোষের ঝিল্লির মধ্যে আবদ্ধ হলে তবেই কাজ করতে পারে।
৪। কারো মতে -প্রথমে প্রাণ ধারণের জন্য মেটাবলিজম বা রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কারণ কোষ গঠনের জন্য নানান ধরণের রাসায়নিক উপাদান এবং শক্তি বা Energy.
সত্যি কথা বলতে, বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন যে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হয়েছিল। DNA, RNA, proteins, enzymes, ribosomes, বা কোষের ঝিল্লি—কোনটি দিয়ে প্রথম কোষের সৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, প্রথমে RNA বা DNA তৈরি হতে হবে, কারণ DNA-তে থাকে কোষের সব Genetic information। আবার কেউ বলেন, DNA বা RNA-এর আগে Enzymes তৈরি হতে হবে, কারণ enzymes-এর প্রভাবেই DNA ও RNA সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু Enzymes হচ্ছে Proteins। DNA ও RNA-এর কাজ হচ্ছে Proteins তৈরি করা। ফলে DNA বা RNA-এর আগে Proteins বা Enzymes তৈরি হওয়া অসম্ভব। এতে একটা “ডিম আগে না মুরগি আগে” এর মতো সমস্যা তৈরি হয়। তাছাড়া, DNA বা RNA-এর মধ্যে genetic information কীভাবে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়েও কারও কাছে পরিষ্কার ধারণা নেই।
এইসব Hypothesis এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় Hypothesis হচ্ছে – RNA World Hypothesis.
RNA World Hypothesis আসলে কি?
- এই ধারণা অনুযায়ী আদিম পৃথিবীতে সবার আগে RNA গঠিত হয়েছিল, কারণ RNA জিনগত তথ্য (Genetic information) সংরক্ষণ করতে পারে এবং নিজেই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে পারে, অর্থাৎ Enzyme হিসাবে কাজ করতে পারে। প্রাণের বিকাশের জন্য প্রথম থেকেই Genetic information লাগবে এবং এনজাইম লাগবে। RNA এর মধ্যে এই দুইটা বৈশিষ্ট একসাথে পাওয়া যায়। এরপর RNA থেকে ধীরে ধীরে protein ও DNA তৈরি হয়েছে। বর্তমানে RNA ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস (hypothesis) হলো abiogenesis-এর একটি অন্যতম প্রধান তত্ত্ব, এই ধারণা অনুযায়ী RNA-ই প্রথম গঠিত হয়।
- সম্ভাব্য ধারাবাহিকতা:
RNA → Protein → DNA → কোষঝিল্লি → পূর্ণ কোষ
কিন্তু আদিম পৃথিবীতে RNA গঠিত হতে পারাটা প্রায় অসম্ভব ঘটনা-
কেন RNA একা একাই তৈরী হতে পারাটা একটি অসম্ভব ঘটনা সেটি এখানে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলো-
RNA মূলত গঠিত হয় তিন ধরনের উপাদান দিয়ে- ১। শর্করা (Ribose sugar), ২। ফসফেট (phosphate) এবং নিউক্লিওবেস (nucleobase)। এর মধ্যে Ribose sugar এবং phosphate একটি বাঁকানো Backbone বা মেরুদন্ড তৈরী করে যার সাথে ৪ ধরনের নিউক্লিওবেস যুক্ত অবস্থায় থাকে।

RNA-র জন্য অপরিহার্য শর্করা বা Ribose সুগার তৈরী হওয়া প্রায় অসম্ভব
RNA (রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) গঠনের জন্য Ribose নামক একটি বিশেষ সুগার বা শর্করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আদিম পৃথিবীতে এই Ribose কি সহজে তৈরি হতে পারত? উত্তর হলো, না। Ribose একটি অত্যন্ত অস্থিতিশীল এবং দুর্লভ সুগার, যা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া এবং টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। এখানে আমরা এই বিষয়টি সহজভাবে বুঝব-
Ribose sugar কীভাবে তৈরি হয়?
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রকৃতিতে Ribose তৈরি হতে পারে Formose reaction নামক একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে Formaldehyde নামক একটি সাধারণ অণু ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে Formose reaction এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সুগার তৈরী হয় (যেমনঃ Glyceraldehyde, Dihydroxyacetone, Glucose, Mannose, Fructose, Ribose ইত্যাদি। যে পরিমান Ribose তৈরী হয় তা অত্যন্ত নগন্য। এই বিক্রিয়ায় Ribose-এর পরিমাণ ১%-এরও কম, যা অন্যান্য সুগারের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ, ১০০টা অণুর মধ্যে ১টারও কম Ribose। ল্যাবরেটরীতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, বিভিন্ন ধরণের মিশ্রণের মধ্যে মিশে থাকা এই অল্প পরিমাণ Ribose কখনই RNA তৈরী করবে না, Ribose সুগারকে অবশ্যই অন্যান্য সুগার থেকে সম্পুর্ণ আলাদা করে ফেলতে হবে। [1]
Ribose তৈরি এবং টিকে থাকা নিয়ে জটিলতা-
- অনেক সুগার একসঙ্গে তৈরি হয়: Formose reaction-এ Ribose ছাড়াও আরও অনেক isomer (অনুরূপ অণু) তৈরি হয়। ফলে Ribose-কে আলাদা করে পাওয়া যায় না। এই মিশ্রণ থেকে শুধু Ribose বেছে নেওয়া প্রাকৃতিকভাবে অসম্ভব।
- দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়: Alkaline পরিবেশে (pH > 9) Ribose খুব দ্রুত ভেঙে যায়।উষ্ণতা (৩০–৮০°C), পানি, বা UV আলোর মতো পরিবেশে Ribose কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।
- আলাদা করা অসম্ভব: Formose reaction-এ Ribose অন্যান্য সুগারের সঙ্গে মিশে থাকে। আধুনিক যন্ত্র ছাড়া এটিকে আলাদা করা সম্ভব নয়। আদিম পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিল না যা Ribose-কে আলাদা করতে পারত।
Ribose Sugar তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত
Ribose তৈরির জন্য যেসব শর্ত দরকার, সেগুলো হলো:
শর্ত | প্রয়োজনীয়তা |
Alkaline pH (>9) | বিক্রিয়া শুরু করতে |
Catalyst (Ca(OH)₂ বা খনিজ) | বিক্রিয়ায় সহায়ক |
উষ্ণতা (৩০–৮০°C) | বিক্রিয়ার গতি বাড়াতে |
সমস্যা:
- এই শর্তগুলো একসঙ্গে এবং সঠিকভাবে পাওয়া আদিম পৃথিবীতে খুবই কঠিন একটি বিষয় ।
- এমনকি Ribose তৈরি হলেও, তা RNA-র গঠনে ব্যবহার হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
উপসংহার
Ribose হলো RNA-র একটি মূল উপাদান, কিন্তু আদিম পৃথিবীতে এর উৎপাদন এবং স্থিতিশীলতা প্রায় অসম্ভব ঘটনা। এর পরিমাণ খুবই কম, এটি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, এবং আলাদা করা অত্যন্ত কঠিন। এই কারণে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রাকজৈবিক পৃথিবীতে Ribose থেকে RNA তৈরি হওয়া একটি বড় রহস্যজনক ঘটনা।
প্রশ্ন উঠছে: যদি Ribose তৈরি হওয়া এত কঠিন ছিল, তাহলে RNA কীভাবে তৈরি হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আদিম পৃথিবীতে ফসফেট: RNA-র জন্য অপরিহার্য কিন্তু তৈরী হওয়া প্রায় অসম্ভব
RNA এবং DNA তৈরির জন্য আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ তিনটি উপাদান হচ্ছে ফসফেট।
ফসফেট হলো একটি রাসায়নিক আয়ন, যার সংকেত PO₄³⁻। এটি তিনটি ঋণাত্মক চার্জ বহন করে এবং RNA ও DNA-র মূল কাঠামো বা “backbone” তৈরিতে সুগারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই কাঠামো ছাড়া RNA বা DNA তৈরি হতে পারে না।
ফসফেট তৈরী হওয়া কেন কঠিন?
- প্রাকৃতিকভাবে ফসফেট খুব কম পাওয়া যায়: ফসফেট সাধারণত মাটি বা খনিজের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, যেমন শিলা বা পাথরে। মুক্ত অবস্থায় (যেমন পানিতে দ্রবীভূত) ফসফেট খুবই অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়, যা RNA তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়।
- ফসফেট সহজে প্রতিক্রিয়া করে না: ফসফেট একটি স্থিতিশীল এবং ঋণাত্মক চার্জযুক্ত আয়ন, যার ফলে এটি সুগার বা বেজের সঙ্গে সহজে যুক্ত হয় না। এটিকে প্রতিক্রিয়া করাতে এনজাইম বা বাইরে থেকে শক্তি (energy) প্রয়োজন, যা আদিম পৃথিবীতে ছিল না।
- পানিতে ফসফেট অবক্ষেপিত হয়: পানিতে ফসফেট দ্রবীভূত না থেকে Precipitate হয়ে পড়ে, অর্থাৎ এটি আলাদা হয়ে তলানিতে জমা হয়। এর ফলে ফসফেট রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না।
কেন এসব বড় সমস্যা?
RNA তৈরির জন্য নিউক্লিওটাইড নামক একটি ইউনিট প্রয়োজন, যা তৈরি হয় এই তিনটির সমন্বয়ে: নিউক্লিওটাইড = সুগার + বেজ + ফসফেট
যদি ফসফেট পরিবেশে না থাকে বা থাকলেও প্রতিক্রিয়া না করে, তাহলে নিউক্লিওটাইড তৈরি হবে না। ফলে RNA বা DNA গঠন সম্ভব হবে না। এছাড় ফসফেটকে প্রতিক্রিয়াশীল করতে শক্তি (energy input) প্রয়োজন, কিন্তু আদিম পৃথিবীতে এই শক্তির উৎস কী ছিল, তা এখনো অস্পষ্ট।
তাহলে প্রশ্ন হলো…
পৃথিবীতে যেখানে কোনো এনজাইম ছিল না, কোনো শক্তির উৎস (যেমন ATP) ছিল না, সেখানে ফসফেট কীভাবে সুগার ও বেজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে RNA-র মতো জটিল অণু তৈরি করল? এটি Abiogenesis বা প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত উৎপত্তি তত্ত্বে একটি বড় প্রশ্ন।
উপসংহার
ফসফেট RNA এবং DNA-র জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান, কিন্তু এটি প্রাকৃতিকভাবে খুবই দুর্লভ এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার দিক থেকে অত্যন্ত নিষ্ক্রিয়। এর প্রাপ্যতা এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সীমিত ক্ষমতা RNA গঠনকে প্রাকজৈবিক পৃথিবীতে প্রায় অসম্ভব। এই সমস্যা বিজ্ঞানীদের জন্য এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা জীবনের উৎপত্তির রহস্য সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ।
আদিম পৃথিবীতে RNA-র চারটি বেজ: Adenine ও Guanine সহজ, কিন্তু Cytosine ও Uracil অত্যন্ত কঠিন
RNA এর চারটি প্রধান নিউক্লিওবেজ হলো Adenine (A), Guanine (G), Cytosine (C), এবং Uracil (U)। প্রাকজৈবিক পৃথিবীতে এই বেজগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। কিন্তু দেখা গেছে, Adenine ও Guanine তৈরি করা তুলনামূলক সহজ, কিন্তু Cytosine ও Uracil-এর ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা রয়েছে।
Adenine ও Guanine: সহজেই তৈরি হয়
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রাকজৈবিক পৃথিবীর পরিবেশে Adenine ও Guanine তৈরি হওয়াটা তুলনামূলক সহজ। এই দুটি বেজ রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হতে পারত। উল্কাপিণ্ডে (যেমন Murchison meteorite) এদের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে এগুলো আদিম পরিবেশে সাধারণ ছিল।
Cytosine ও Uracil: কেন এত জটিল?
Cytosine ও Uracil তৈরি করা অনেক কঠিন। বিশেষ করে Cytosine নিয়ে বড় সমস্যা রয়েছে। আসুন দেখি কেন:
Cytosine-এর সমস্যা
- গঠন করা কঠিন: Cytosine তৈরির জন্য যে রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রয়োজন, সেগুলোর জন্য খুব বিশুদ্ধ ও ঘন রাসায়নিক পদার্থ দরকার, যা আদিম পৃথিবীতে পাওয়া কঠিন। উদাহরণস্বরূপ:
- Cyanoacetylene + Urea
- Cyanoacetaldehyde + Ammonia এই বিক্রিয়াগুলোতে উৎপাদন মাত্রা (yield) খুব কম, প্রায় ১% এরও নিচে। এছাড়া অনেক অপ্রয়োজনীয় পার্শ্ব-বিক্রিয়া ঘটে।
- পানিতে অস্থিতিশীল: Cytosine পানিতে সহজেই ভেঙে যায়। এটি রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে Uracil ও Ammonia-তে রূপান্তরিত হয়।
- ২৫°C তাপমাত্রায় এর অর্ধ-আয়ু মাত্র ১৭ দিন।
- ৩৭°C তাপমাত্রায় তা কমে ১৪ দিন।
- এমনকি শীতল পরিবেশে (০°C) এটি সর্বোচ্চ ১৭,০০০ বছর টিকে থাকে, যা ভূতাত্ত্বিক সময়ের তুলনায় খুবই কম।
- পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ: UV আলো, তাপ, পানি, বা অ্যাসিডিক পরিবেশে Cytosine দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। আগ্নেয়গিরির মতো উচ্চ তাপমাত্রার জায়গায় এটি মুহূর্তের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য Cytosine-কে বিজ্ঞানীরা “ক্ষণস্থায়ী অণু” বলেন।
- কোনো প্রমাণ নেই: উল্কাপিণ্ডে Adenine, Guanine, এমনকি Uracil ও Thymine পাওয়া গেলেও Cytosine-এর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এর মানে হতে পারে Cytosine হয় তৈরিই হয়নি, নয়তো তৈরি হয়েও দ্রুত ধ্বংস হয়ে গেছে।
Uracil-এর ক্ষেত্রে
Uracil-এরও Cytosine-এর মতো কিছু সমস্যা রয়েছে, তবে এটি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। উল্কাপিণ্ডে Uracil পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এটি আদিম পরিবেশে তৈরি হতে পারত। তবে এর গঠন প্রক্রিয়াও জটিল।
উপসংহার
Cytosine ও Uracil-এর অস্থিতিশীলতা এবং গঠনের জটিলতার কারণে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রাকজৈবিক পৃথিবীতে RNA তৈরির প্রক্রিয়া হয়তো আমরা যা ভাবছি, তার থেকে ভিন্ন ছিল। কিছু বিজ্ঞানী এমনও ধারণা করেন যে প্রাচীন RNA-তে Cytosine ছিল না, বা এটি ভিন্ন কোনো অণু দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। এই রহস্য সমাধানে এখনো গবেষণা চলছে।
📌 মূল কথা: Adenine ও Guanine তৈরি হওয়াটা সহজ, কিন্তু Cytosine ও Uracil-এর জটিলতা আদি পৃথিবীতে RNA-র উৎপত্তি নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন, যা আমাদের জীবনের উৎপত্তি বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
RNA-এর অস্থিতিশীলতা প্রাণের উৎপত্তিতে বড় চ্যালেঞ্জ
ধরে নেওয়া যাক, কোনো অজানা প্রক্রিয়ায় সুগার, ফসফেট অণু এবং নিউক্লিক এসিড সংযুক্ত হয়ে RNA অণু তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তখনও একটি বড় সমস্যা থেকে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে RNA অত্যন্ত অস্থিতিশীল এবং সেই সময়ের কঠিন পরিবেশে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
আদিম পৃথিবীতে কোনভাবে RNA তৈরী হলেও কি টিকতে পারত?
RNA একটি খুবই অস্থিতিশীল অণু। আদি পৃথিবীর পরিবেশে তাপ, আলো, পানি, বা রাসায়নিক পদার্থের কারণে এটি দ্রুত ভেঙে যেত। RNA-এর Ribose সুগারে একটি অতিরিক্ত –OH (হাইড্রক্সিল) গ্রুপ থাকে, যাকে বলে 2′-OH। এই 2′-OH গ্রুপের কারণে RNA অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল বা Unstable হয়ে ওঠে। সাধারণ প্রকৃতিক পরিবেশে RNA কণা খুব অল্প সময় টিকে থাকতে পারে। নিচে একটি চার্টে বিভিন্ন পরিবেশে RNA-এর স্থায়িত্ব (half-life) দেখানো হলো:
🧪 পরিবেশ | ⏳ RNA-এর Half life | 💬 মন্তব্য |
ঘরের তাপমাত্রা (২৫°C), নিরপেক্ষ pH | কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন | এনজাইম ছাড়াও দ্রুত ক্ষয় হয় |
RNase (প্রাকৃতিক এনজাইম) উপস্থিতিতে | সেকেন্ড থেকে মিনিট | RNase সর্বত্র থাকে, RNA দ্রুত ধ্বংস করে |
উচ্চ তাপমাত্রা (৬০–৮০°C) | সেকেন্ড থেকে ঘণ্টা | আদিম পৃথিবীর তাপে RNA সহজেই নষ্ট হতো |
ক্ষারীয় পরিবেশ (pH > ৮) | মিনিট থেকে ঘণ্টা | RNA-এর ব্যাকবোন ভেঙে যায় |
অম্লীয় পরিবেশ (pH < ৫) | খুব দ্রুত | গ্লাইকোসিডিক বন্ধন ভেঙে যায় |
UV রশ্মির সংস্পর্শে | তাৎক্ষণিক ক্ষতি | RNA-এর বেজ ভেঙে যায় বা রাসায়নিক পরিবর্তন হয় |
মূল কথা: প্রাকজৈবিক পৃথিবীর প্রতিকূল পরিবেশে (তাপ, UV আলো, অম্ল বা ক্ষারীয় অবস্থা) RNA তৈরি হলেও তা খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যেত। ফলে এটি দীর্ঘসময় টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
RNA প্রতিলিপি (Self-replication) সমস্যা
RNA World Hypothesis বলে, RNA নাকি নিজে নিজের কপি বানাতে পারত, যা জীবনের শুরুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই ধারণার সঙ্গে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে:
- নিজে কপি করার ক্ষমতা: বর্তমানে বিজ্ঞানীরা এমন কোনো RNA অণুর সন্ধান পাননি যা নিজে নিজেকে পুরোপুরি এবং নির্ভুলভাবে কপি করতে পারে।স্ব-প্রতিলিপির জন্য এনজাইম বা ক্যাটালিস্ট প্রয়োজন, যেগুলো প্রাকজৈবিক পৃথিবীতে ছিল কিনা, তা অজানা।
- এনজাইম ছাড়া অসম্ভব: এনজাইম বা অন্য কোনো সহায়ক অণু ছাড়া RNA-এর প্রতিলিপি তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন, প্রায় অসম্ভব। আদিম পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিল না যা এই কাজে সাহায্য করতে পারত।
ফলাফল: RNA-এর স্ব-প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতা শুধু তত্ত্বে সম্ভব, বাস্তবে এটি খুবই প্রশ্নবিদ্ধ।
উপসংহার
RNA তৈরি হলেও, প্রাকজৈবিক পৃথিবীর কঠিন পরিবেশে এটি টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। তাপ, আলো, বা রাসায়নিক পদার্থের কারণে RNA দ্রুত ধ্বংস হয়ে যেত। এছাড়া, Self-replication জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম বা ক্যাটালিস্ট ছাড়া RNA নিজের কপি বানাতে পারত না। এই কারণে RNA World Hypothesis, যেখানে RNA-কে জীবনের প্রথম অণু হিসেবে ধরা হয়, তা অনেক বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের মুখে পড়ে।
সংক্ষেপে, আরএনএ (RNA) ওয়ার্ল্ড হাইপোথিসিস জীবনের উৎপত্তির একটি শক্তিশালী তত্ত্ব হলেও, এর রাসায়নিক জটিলতা, অস্থিতিশীলতা, এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে এটি এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রমাণিত হয়নি। বিজ্ঞানীরা এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও অনেক সমস্যা
- Bonding সমস্যা: RNA-র nucleotides গুলোকে লম্বা শৃঙ্খলে যুক্ত করা পানিতে প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব নয়, কারণ পানি এই বন্ধন নষ্ট করে দেয় (hydrolysis ঘটায়)।
🧪 ২. Homochirality সমস্যা
- মানুষের যেমন ডান হাত এবং বাম হাত আছে, ঠিক তেমনি রাসায়নিক পদার্থেরও ডান এবং বাম আছে। একে বলা হয় Homochirality। সুগারের মধ্যে ডান হাতের সুগার এবং বাম হাতের সুগার আছে। গবেষণায় দেখা গেছে RNA গঠনের জন্য শুধু D-ribose দরকার। যদি D ও L উভয় ধরনের ribose উপস্থিত থাকে: RNA চেইন সঠিকভাবে তৈরি হয় না। Base pairing এবং গঠন নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ribozyme কাজ করতে পারে না। Racemic mixture থেকে কার্যকর RNA তৈরি হয় না — homochirality আবশ্যক। প্রশ্ন হচ্ছে এই আলাদা করার জন্য আদিম পৃথিবীতে তো কোন মেশিন ছিল না, তাহলে কিভাবে সুগারগুলো আলাদা হয়েছিল?
- একই ভাবে amino acids এর মধ্যে ডান হাতের এবং বাম হাতের আছে। কিন্তু প্রাকৃতিক প্রোটিন শুধুমাত্র L-amino acids দিয়ে তৈরি।
- (RNA-তে ব্যবহৃত চিনি) এবং amino acids উভয়েরই দুই ধরনের chirality থাকে:
- D-form (right-handed)
- L-form (left-handed)
🧬 RNA ও DNA শুধুমাত্র D-ribose ব্যবহার করে।
⚠️ কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে D-ribose এর জন্য কার্যকর homochirality প্রক্রিয়া নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি। Homochirality ছাড়া কার্যকর RNA গঠন সম্ভব নয়। আর RNA ছাড়া RNA World Hypothesis (জীবসৃষ্টির জনপ্রিয় তত্ত্ব) কাজ করে না।
কোনো ভূতাত্ত্বিক বা জীবাশ্ম প্রমাণ নেই
- RNA World-এর পক্ষে কোনো সরাসরি জীবাশ্ম প্রমাণ নেই—এমন কোনো প্রাচীন RNA-ভিত্তিক জীবন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজকের সব জীব DNA ও প্রোটিন ব্যবহার করে; RNA-ভিত্তিক জীবন শুধুই একটি অনুমান।
- তাছাড়া যেসব ল্যাবরেটরির পরীক্ষার নাধ্যমে RNA World Hypothesis কে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় সেখানে দেখা যায় বিভিন্ন বিশুদ্ধ উপাদান (Pure chemicals) ব্যবহার করা হয় যা প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। মানুষের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ছাড়া এই বিক্রিয়াগুলো ঘটে না, যা স্বাভাবিক বা স্বয়ংক্রিয় জীবন উৎপত্তির ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক।
উপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেলাম পৃথিবীতে প্রাকৃতিক উপায়ে RNA কণা উদ্ভব হতে পারাটা কতটা জটিল একটি বিষয়, অথচ আধুনিক বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত যে প্রাণের সূচনা ঘটতে হলে প্রথমে অন্ততঃ RNA কণার উদ্ভব হতে হবে এবং সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে কোষের অন্যান্য উপাদান হয়ত উদ্ভব হতে পারে। আধুনিক ল্যাবেরটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তাঁরা এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোন সফলতা পাওয়া যায় নি। বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এই বিষয়টি স্মীকার করেছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে Abiogenesis নিয়ে গবেষণা করছেন , এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- Professor James tour, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী- Jack Szostak, ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের John Sutherland সহ আরোও অনেকে। Professor James Tour তো রীতিমত অন্যান্য বিজ্ঞানীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ যানিয়েছেন যে কেউই Abiogenesis পক্রিয়া প্রমাণ করে দেখাতে পারবে না।
এই বিষয়ে নীচের ভিডিওগুলো পাঠকদের গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে-
Origin of life Challenge RESULTS.
The origin of life has never been explained.
📚 বৈজ্ঞানিক সূত্র
· Reference:
Benner, S. A., Kim, H.-J., & Yang, Z. (2010).
“Setting the Stage: The History, Chemistry, and Geobiology Behind RNA.”
Cold Spring Harbor Perspectives in Biology, 2(10): a003541.
https://doi.org/10.1101/cshperspect.a003541
Li & Breaker (1999): “RNA degradation kinetics” — RNA rapidly degrades in alkaline conditions, breaking down within minutes.
📖 Reference: Li, Y., & Breaker, R. R. (1999). Kinetics of RNA degradation by specific base catalysis of transesterification involving the 2′-hydroxyl group. Chemistry & Biology, 6(10), 793–803.
· Powner et al. (2009, Nature): Certain ribonucleotide components can be synthesized under prebiotic conditions, but the assembly of these into full RNA strands remains unresolved.
📖 Reference: Powner, M. W., Gerland, B., & Sutherland, J. D. (2009). Synthesis of activated pyrimidine ribonucleotides in prebiotically plausible conditions. Nature, 459(7244), 239–242.
· Joyce & Orgel (1993): From a prebiotic chemist’s perspective, the formation of RNA is described as a “prebiotic chemist’s nightmare.”
📖 Reference: Joyce, G. F., & Orgel, L. E. (1993). Prospects for understanding the origin of the RNA world. In The RNA World (eds. Gesteland, R. F. & Atkins, J. F.), Cold Spring Harbor Laboratory Press.
The Messy Alkaline Formose Reaction and Its Link to Metabolism