কুরআনে প্যানসাইকিজম (Panpsychism)
প্যানসাইকিজম (Panpsychism) কী?
শব্দভিত্তিক বিশ্লেষণ
- Pan = সব/সর্ব (Greek “πᾶν”)
- Psyche = আত্মা, মন বা চেতনা
- সুতরাং Panpsychism = সর্বত্র চেতনার উপস্থিতি
বাংলায় একে বলা যেতে পারে: সর্বচৈতন্যবাদ বা সর্বমহাবিশ্বে চেতনা বিদ্যমান মতবাদ।
- দর্শনের একটি ধারণা হচ্ছে চেতনা বা অনুভূতি কেবল মানুষ বা প্রাণীতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিসে—পরমাণু, উদ্ভিদ, প্রাণী, এমনকি জড় বস্তুতেও—কোনো না কোনো স্তরের চেতনা বা মানসিক গুণাবলি রয়েছে।
- সহজভাবে: সবকিছুর ভেতরেই কিছুটা “মন-সদৃশ” বৈশিষ্ট্য আছে।
- প্যানসাইকিসম অনেক পুরাতন একটি ধারণা হলেও মূল ধারার বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টিকে স্বীকার করতেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্যানসাইকিসম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে ধীরে ধীরে মেনে নিতে শুরু করেছেন। কেননা সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় কোষ, নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী, এবং কোয়ান্টাম স্তরে চেতনার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
- কোয়ান্টাম স্তরে চেতনার উপস্থিতি Quantum Consciousness Hypothesis নামে পরিচিত, যেটি মূলত Sir Roger Penrose (গণিতবিদ) এবং Stuart Hameroff (অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট) এর Orch-OR তত্ত্ব থেকে জনপ্রিয় হয়েছে। দেখা গেছে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে কণাগুলি একই সাথে একাধিক অবস্থায় থাকতে পারে (superposition)। কিন্তু পর্যবেক্ষণ বা মাপ নেওয়ার সময় তারা “collapse” হয়ে নির্দিষ্ট অবস্থা নেয়। কিছু বিজ্ঞানী ভাবেন—চেতনার অভিজ্ঞতা (subjective awareness) আসলে এই collapse প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারে।
- সাম্প্রতিক সময়ে Michael Levin (Tufts University) একজন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরের হঠন একক ” কোষের” মধ্যে একধরনের “বুদ্ধিমত্তা” বা “সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা” আছে, যাকে অনেক বিজ্ঞানী প্রাথমিক চেতনা (proto-consciousness) বলে ভাবছেন। Levin দেখিয়েছেন যে কোষেরা শুধু DNA বা কেমিক্যাল সিগনাল দিয়ে কাজ করে না। বরং তারা বৈদ্যুতিক ভোল্টেজের প্যাটার্ন (bioelectric signals) ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। এই bioelectric “language” ব্যবহার করে কোষেরা ঠিক করে কোথায় অঙ্গ (যেমন হাত, চোখ) তৈরি হবে। তার গবেষণা থেকে বোঝা যায় যে- ১/ Cellular Cognition–কোষেরা পরিবেশ বোঝে, সিদ্ধান্ত নেয়, এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পারে। ২/ Memory & Goal-Directed Behavior–কোষেরা দেহের নকশা (body plan) মনে রাখে এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে। এটি একধরনের intentionality—যা চেতনার বৈশিষ্ট্য।
- নানান গবেষণায় এক কোষী ব্যাকটেরিয়া, প্রটোজোয়া এমনকি উদ্ভিদের মধ্যেও চেতনা আর বুদ্ধিমত্তার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
কুরআনের বক্তব্য (সংশ্লিষ্ট ধারণা)
কুরআনে সরাসরি প্যানসাইকিজম শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি (এটি গ্রিক/আধুনিক দর্শনের পরিভাষা), তবে কুরআনে বারবার বলা হয়েছে—আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি জিনিসই সচেতন, এবং আল্লাহকে সিজদা ও আল্লাহর তাসবিহ করে।
১. সবকিছু আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে
“সাত আসমান, জমিন ও তাতে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। এমন কোনো বস্তু নেই যা তাঁর প্রশংসা করছে না; তবে তোমরা তাদের তাসবিহ বোঝ না।”
— [সূরা আল-ইসরা ১৭:৪৪]
এর মানে হলো—আমরা যেগুলোকে জড় ভাবি, সেগুলোরও এক প্রকার সচেতনতা আছে, যা দ্বারা তারা আল্লাহর প্রশংসা করে।
২. সবকিছু আল্লাহর কাছে সিজদাহ করে
“তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর কাছে সিজদাহ করছে আসমানসমূহে ও জমিনে যা কিছু আছে—সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র, পর্বত, বৃক্ষ, জীবজন্তু ও অনেক মানুষও?”
— [সূরা আল-হাজ্জ ২২:১৮]এখানে শুধু জীবিত প্রাণী নয়, বরং সূর্য, চাঁদ, পর্বত ও বৃক্ষকেও সিজদাহরত বলা হয়েছে।
৩. আসমান ও জমিনের আনুগত্য
“অতঃপর তিনি ধোঁয়া অবস্থায় আসমানের দিকে মনোযোগ দিলেন, এবং তাকে ও জমিনকে বললেন: ‘তোমরা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসো।’ তারা বলল: ‘আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম।’”
— [সূরা ফুসসিলাত ৪১:১১]
এতে দেখা যায়, আসমান ও জমিনকেও এক প্রকার যোগাযোগ ও প্রতিক্রিয়া প্রদানকারী সত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সারসংক্ষেপ:
কুরআনে প্যানসাইকিজম দর্শন শেখানো হয়নি, তবে সৃষ্টিজগতের মধ্যে চেতনা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে প্রতিটি সৃষ্টিই আল্লাহর সচেতন দাস, যারা তাঁর প্রশংসা ও সিজদায় লিপ্ত।
এটি একধরনের “সর্বসচেতন ঈশ্বরবাদ” (pan-conscious theism)—সবকিছুর মধ্যেই সচেতনতা আছে, কিন্তু তা সর্বদা তাদের স্রষ্টার দিকে মুখী।
আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জড় বস্তু, অনু-পরমাণু, উদ্ভিদ ইত্যাদের মধ্যে চেতনা থাকার বিষয়টি ধীরে ধীরে আমাদের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে, যা কুরআনের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।